মধুর সে লগন (modhur se logon)

মধুর সে লগন °°°°°°°°°°°°°°°°°° সুদীপ ব্যানার্জী


 সেও এক শ্রাবণদিন।আমরা তখন এইট বা নাইনে পড়ি।সকাল থেকেই প্রচন্ড উত্তেজনা।ড্রইং খাতায় জাতীয় পতাকা আগের দিনই আঁকা কমপ্লিট।কঞ্চিতে আঠা লাগিয়ে পতাকার সেঁটে ফেলাও শেষ।খালি আকাশ বেশ গোলমাল শুরু করেছে।মাঝেমাঝেই কয়েক পশলা বৃষ্টি। ও হ্যাঁ,বলতে ভুলে গেছি --- দিনটা ছিল ১৫ ই আগস্ট। অন্যান্য বছরের থেকে একটু স্পেশাল । স্বাধীনতার পঞ্চাশবছর পূর্তি। তাই বয়েজস্কুল থেকে র‍্যালি বেরোবে।স্যারেরা বারবার বলে দিয়েছেন পতাকা বানিয়ে আনার কথা।আমার পতাকা রেডি।সেই বিখ্যাত সাদাজামা খাঁকি প্যান্ট পরে বুট গলাচ্ছি। দীপঙ্কর মিত্র স্যারের উদ্যোগে তখন বুট পরা মাস্ট।নীচে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আর "সুমনু...সুমনু" ডাক।গুবলু (সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় মানে শিল্পী রাণাদার খুড়তুতো ভাই)এসে গেছে।ও আমার পুরোনোপাড়ার বন্ধু ---সেই ক্লাস ওয়ান থেকেই।এই পুরনোপাড়ার কথা আর শ্রাবণমাসের প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে যায় শিবমন্দিরের মাঠে ভিজে ভিজে ফুটবল খেলার কথা।খোকনদা,রাজাদা,নন্দদা,গণেশদা,চন্দন্দা,লালদা,পাপান,রাহুল... এদের মুখগুলো মনে পড়ে যায়।আর মনে পড়ে বিকাশকাকু,উত্তমকাকু,দিলীপকাকু (ঘোষ বুক স্টোর) এবং আরও অনেকের দ্বারকেশ্বরে শ্রাবণের সোমবার শিবের মাথায় জল ঢালতে যাওয়ার কথা।এখনও কর্মসূত্রে তারকেশ্বরের দিকে যেতে যেতে জল ঢালতে আসা পূণ্যার্থীদের দল দেখি।কিন্তু ছেলেবেলার সে "বোল্ ব্যোম্" ধ্বনির মতো সুর কোথাও শুনতে পাইনা।     সাইকেলে করে দুইবন্ধু স্কুলে ঢুকতেই দেখি স্টেজের সিঁড়ির কাছেই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে পবিত্র (নামটি পাল্টালাম)।তো এই পবিত্রকে নিয়ে দু-চার কথা না বললে এই স্মৃতিকথা পূর্ণতা পাবে না।ওর বাড়ি ছিল খ্রিস্টানপাড়ায় এবং তখন  সম্ভবতঃ আদ্রার একমাত্র মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্টের দোকানটি ছিল ওদের।কিছুদিন আগেও আমাদের ৯৮' এর মাধ্যমিক হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপে গিটারের সাথে ওর গাওয়া অনবদ্য গান শুনেছি।স্কুলজীবনে ও ছিল রীতিমতো একটি ক্যারেক্টার।মোটামুটি পড়া না দেওয়ার জন্য বেশিরভাগ সময়ে রুনু ঘোষ স্যারই হ'ন বা ঘোষাল স্যার...ওকে বেঞ্চের ওপর কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিতেন।এই নয় যে ও  পড়া করে আসেনি,কিন্তু পড়া দেওয়ার চেয়ে শাস্তি পাওয়াটাই ও বেশি উপভোগ করতো।দিলীপস্যার উপপাদ্য বোঝালে খুব ছোট করে লিখে রাখতো।জিগ্যেস করলে উত্তর "আবার কে খাটবে?টুকলি রেডি"!!! এ হেন পবিত্র বেঞ্চের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না।কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রায় দশদিকেই স্থান পরিবর্তন হয়ে যেতো।রসিক চূড়ামণি শ্রদ্ধেয় বিজন সেনগুপ্ত স্যার আদর করে ওর নাম দিয়েছিলেন " ওয়েদার কক্" বা "বাতপতাকা"। বলাইবাহুল্য যে সব স্যারের ক্লাসেই এই আচরণের পরিনতি সুখকর হতো না।এখন পবিত্র বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে।" কি রে?কী হল?",বলতে পবিত্রর উত্তর," সব্বোনাশ হয়েছে।পতাকা তৈরী করতে ভুলে গেছিলাম।সকালে উঠে ঘুমচোখে পতাকা রেডি করে স্কুলে আসছি,ভগৎ সিংএর স্ট্যাচুর কাছে এসে দেখি ভারতের পতাকার ওপরে গেরুয়া।"ওর পতাকাটা বের করতে বলায় যা বেরিয়ে এলো আদতে তা নারকেল ঝাঁটার কাঠিতে এক টুকরো কাগজ ফুঁটো করে লাগানো যার উপরে সবুজ নীচে গেরুয়া।এদিকে সি.আর. পাল স্যার সবার পতাকা চেক করছেন।সে যাত্রা ওকে  উদ্ধার করতে আমি আর গুবলু জাস্ট কাগজটাকে সাবধানে উল্টোদিকে তুলে গেরুয়াকে ওপরে স্থান দিলাম।কিন্তু স্যারের কঞ্চির ঘা থেকে বাঁচানো গ্যালো না।     ৷ র‍্যালি বেরিয়ে পড়েছে লাইন দিয়ে...বেশ কিছুটা দূর অব্দি এগিয়েও গেছি আমরা। চারদিক কাঁপিয়ে চ্যাঁচাচ্ছি "বন্দে মাতরম"," ভারতমাতা কি জয়"...ছাতনামোড়ের কাছে আসতেই ঝমঝমিয়ে নামলো বৃষ্টি।আর যায় কোথায়... একদল গিয়ে ঢুকে পড়লো আশেপাশের দোকানগুলোতে।স্যারেরা কিন্তু ডিসিশন নিলেন র‍্যালি চালিয়ে যাওয়ার।ধরে আনা হল সেই দলছুটদের।বৃষ্টিও চলছে... র‍্যালিও।ভিজে সব একসা।এইসময় হিন্দি মিডিয়ামের কেউ বলে উঠলো "বোল ব্যোম"... আর যায় কোথায়..." বন্দে মাতরম","ভারত মাতা কি জয়" স্লোগান উধাও।সব ছাত্রের মুখেই "বোল ব্যোম" ধ্বণি।স্যারের প্রমাদ গুনলেন।র‍্যালির মুখ ঘুরে গেলো স্কুলের দিকে। স্কুলের কাছাকাছি এসে বৃষ্টিও থেমে এলো।লাইন করে ঢুকে স্টেজের সামনে ক্লাসওয়াইজ দাঁড়িয়ে গেলাম সবাই।ভেতরের গেটে নিমাই জ্যাঠু তালা দিলেন।আর তারপর...ইতিহাস!!! অসিতস্যার একটা ভাঙা বেঞ্চের পায়া নিয়ে এলোপাথাড়ি মার শুরু করলেন।যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে।আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু আশ্রয় নিলাম লাইব্রেরির সামনের বারান্দায়।একটু পরেই বারান্দার সামনে অসিত স্যার।সামনে আমাদের ক্লাসের সোহন কুন্ডু।জিমকরা শরীর।পায়ে স্যার মারতেই বেঞ্চের পায়া দুটুকরো।স্যারের রাগ আরও বেড়ে গেল।লাইব্রেরির বারান্দায় ঢুকে পড়েছেন টুকরো পায়া নিয়েই।এমন সময় সুপ্রতীম (অমল চক্রবর্তী স্যারের ছেলে) বলে উঠলো,"স্যার,এ তো অন্ধকূপ হত্যা হয়ে যাচ্ছে"...সাথে আমার সংযোজন, "আপনাকে জালিয়ানওয়ালাবাগের জেনারেল ডায়ারের মতো লাগছে"... ব্যস...আগুনে ঘি...স্কুলজীবনে করবীপিসি আর সি.আর.পাল স্যারের কাছে ছাড়া মার খাইনি কোনওদিন...সেদিন অসিতস্যারের কাছে যা খেলাম সাতদিন ব্যথা রয়ে গিয়েছিল।   ৷ বাড়ি ফিরলাম।একটু পরে বাবাও বাড়ি ফিরলো।আমি এমন ভাব করে ছিলাম যেন কিছুই হইনি।বাবা হাসতে হাসতে বলে উঠলো " কি বোল ব্যোম? ব্যথা কেমন?"।জানলাম অসিতস্যার গবাইকাকুর (বাসু বুক স্টোর)দোকানের আড্ডায় সব ফাঁস করে দিয়েছেন...

google.com, pub-4286055196262572, DIRECT, f08c47fec0942fa0

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

তিনটি লেখা...