মাঝরাতের কবিতা

সুদীপ ব্যানার্জী

শব্দ নেই।ফ্লাইওভারে দাঁড়িয়ে দু হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি। সন্ধ্যা পেরিয়ে  মাঝরাত... প্রেমিকাকে আজ  একলা পেয়েছি কাছে..চাঁদ ব্লাশ করছে ঠিক,ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের ঘেরাটোপ...ঠোঁটে জোনাকি মেখেছি.. মুছে গেছে লিপস্টিক...তৃপ্তির ভেজা গন্ধ নাসারন্ধ্রে। ডিজেলের পরিবর্ত।নব্বই মিনিট অতিক্রান্ত।অ্যাডেড টাইমে  সদ্যজাত এ দ্বীপ পরিসর চাইছে আরও...

মেট্রোর জনসমুদ্রে এখনও একটানা ঘুমন্ত জলোচ্ছ্বাস । গরম নিঃশ্বাস।বড় বেশী নিষ্প্রাণ! এখনও বেঁচে ...প্রিয় মাঝ রাত।হাওয়া বইছে। পিউবার্টির মতোই অমোঘ...পবিত্র।সারাদিন ভার্জিনিটি নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পর... ব্যস্ত শহর নড়াচড়ায় অক্ষম এই মুহুর্তে...সব চিল্ড্রেন'স পার্ক খুলছে...গভীর রাত। খুশি দোল খায়।চুপচাপ। ভয়ে ভয়ে...সাঁতরে ঐ কয়েক  দমকা অবহেলা,খুব শিশু ওরা...মুঠো করে ধ'রে স্বাধীণ স্বাধীন আরেকটু জীবন্ত রাত্রিবেলা...ভোরবেলা বালিঘড়ির চোখ  চিক্ চিক্ করে...

আদ্রার মহালয়া

  
  ভোরবেলায় শব্দবাজী আর  রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডিপাঠ গড়পড়তা বাঙালির গতানুগতিক মহালয়ার নস্টালজিয়া। রেল শহর আদ্রার শারদ সকালেও  এই তো সেদিনও মহালয়া নেমে আসতো ডি.এস.টুফর্টি টু বাই সি তে।আমাদের বাড়ির  পরিচয় ছিল এই নম্বরটাই। বাল্যবন্ধু, সহপাঠী শাশ্বত'র কাছে শুনেছি সেই বাড়ি আর নেই।এক জীবনে মানুষের যে ক'টা বাড়ি বাড়ি হয়ে ওঠে!
      যাক্।মহালয়ায় ফিরে যাই...তো মহালয়ার ভোর আমাদের ওখানেও আর চার -পাঁচটা জায়গার মতোই তবুও কতোই না মৌলিক,কতোই না আপন। ব্যাকগ্রাউন্ডে ট্রেনের সাইরেন... মহালয়ার ভোর নামছে  "বাজল তোমার আলোর বেণু" উচ্চারণের অবকাশে ট্রেন ছাড়ার হুইসল... নতুন শুরুকে এ ভাবে স্বাগত জানানো হয় আর কোথায়?এরপর যদি বলি, পৌনে পাঁচটা নাগাদ চণ্ডীমন্ত্র আর অদূরের মসজিদের আজান মিলেমিশে ডি-এস টু ফর্টি টু'র এক বালকের মনে যে অনুরণন তৈরী করত একতার... তারই সুর ছুঁয়ে আজও বেঁচে আছি---তাহলে খুব ভুল বলা হবে না।
      আজও মহালয়া আসে...মহালয়া যায়...কিন্তু রেখাপাত করে না।কি জানি সেই পরিবেশটা পাই না বলেই এটা হয় না কি!
           সেই ছোটবেলায় রোমাঞ্চিত আমি, বুকের ভেতর কেমন কেমন আনন্দ নিয়ে এখনও জেগে উঠতে চাই...সামনের মাঠ,নর্থ হেলথ সেন্টার,প্রাইমারী স্কুল ছাড়িয়ে...এখনও কি তেমনই মহালয়া নামে?মিলিয়ে নেওয়ার ফুরসত মেলে না!
         বেনিয়াশোল পেরিয়ে রঘুনাথপুরের দিকের শ্মশাণে শুয়ে থাকা আমার  মা ---আদ্রা থেকে উঠে এসে মহালয়ার ভোরে কপালে হাত বুলিয়ে দেবে মিষ্টি করে, ঘুম ভাঙিয়ে বলবে,"সুমন,ওঠ...রেডিওতে মহালয়া শুরু হচ্ছে"...এ স্বপ্নটি প্রায়ই দেখি...জানি ভোরে দেখা স্বপ্নও সত্যি হয় না...
        কিছু শিউলি ফুলের গন্ধ... আমার গ্রামের বাড়ির ভোরবেলা...আজও আগমনি গান গাইতে গাইতে ভোরবেলা খঞ্জনি বাজিয়ে এক সুমধুর কন্ঠ উমার বাড়ি ফিরে আসার গান গেয়ে যায়।আদ্রার সেই মহালয়া আর আসে না....

google.com, pub-4286055196262572, DIRECT, f08c47fec0942fa0

বাসি লবানের দেশে

বাসি লবাণের দেশে (১)
♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥
     সুদীপ ব্যানার্জী
♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦

"আজব রং ফকিরি সাধা সোহাগিনী সাঁই।
ও তার চুপিসারি ফকিরি ভেক কে বুঝিবে রাই।।
সর্বকেশী মুখে দাড়ি
চরণে তার চুড়ি শাড়ি
কোথা হতে এল সিড়ি

... জানতে উচিত চাই।।
ফকিরি গোরের মাঝার
দেখ হে করিয়া বিচার
ও সে সাধা সোহাগী সবার
আধ ঘর শুনতে পাই।।
সাধা সোহাগিনীর ভাবে
প্রকৃতি হইতে হবে
সাঁই লালন কয়, মন পাবি তবে
ভাব সমুদ্রে থাই।।"
     
ঠিক দশ বছর আগে বর্ধমান থেকে মার্চ মাসের এরকম দিনেই  বাসে চেপেছিলাম।লাগেজ বলতে কিছু জামা- কাপড়, বেডিং--- যে টুকু না নিলেই নয়।ওখানে থাকতে পারবো না চির জীবন ---এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম।আজ দশ বছর পর আবার ফিরছি সেখানে একটা জরুরি  কাজে।বাস তিনকুনিয়া ছাড়িয়ে স্টেশণ পেরোচ্ছে। আশেপাশের অনেক কিছুই বদলেছে। আমিও বদলেছি সময়ের নিয়মে।জি.টি রোডের ওপর সেই সস্তার পাইস হোটেল যেখানে হোর্ডিং ঝুলতো--"পেট ভোরে ভাত ছয় টাকায়",সেটা দেখলাম না। ঝকঝকে কিছু নতুন দোকান কচুরি, জিলিপি,সীতাভোগ নিয়ে এই সকাল ছ'টাতেই বেশ সরগরম।সেদিনের সেই সকালটা এতো চকচকে ছিল না।বর্ধমান টাউন পেরিয়ে উত্তরে বাস যত এগিয়ে গেল ততই আশপাশের মাঠ,বাড়ি,মানুষগুলো ক্রমশঃ বড় বেশি ধুলো মাখামাখি করে বছর ২৩এর যুবকের চোখে  প্যাস্টেল কালারে এক রঙীণ কিন্তু যেন কিছুটা মলিন জগতের সঙ্গে অযাচিতভাবে পরিচয় পর্ব সেরে নিতে চেয়েছিল।এই যে প্রথম দেখা,এ যে শুধুই প্রস্তুতি ---প্রস্তুতি এক অন্য অধ্যায়ের,এক অন্য পথে হেঁটে যাওয়ার সূচনা--- বুঝিনি।আনু'দার ডাকে চিন্তাসূত্র কেটে গেল,"অনেক দিন পর এ লাইনে---ট্রান্সফার হয়ে গেছেন, না কি?সুরথবাবু কেও দেখি না"!আনুদা!বাস কন্ডাক্টর এই লাইনে বহুদিনের।তখন ওর বাসেই সোমবার যাওয়া আর শণিবার ফিরে আসা।না কি সোমবার ফিরে আসা আর শণিবার যাওয়া?আনুদার দিকে হেসে ভাড়া দিয়ে দিলাম সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে।বরাবরই আমি কম কথা বলি, আনুদা জানে..."আর বলবেন না,আজকালকার প্যাসেঞ্জারদের কথা।ছিল সেই সব দিন...আপনারা হৈ হৈ করতে করতে যেতেন... আমাদের সাথে মিশে যেতেন...এখন গাড়িও বেড়ে গেছে...আর... "...আনুদা আরও কিছু বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে গেল বাসের সামনের দিকে।সেদিনের কথা আবার মনে পড়ে গেল।আনুদার বাসেই তো চেপেছিলাম।গন্তব্যস্থলের নাম বলে দিয়েছিলাম।এলে জানিয়ে দিতেও অনুরোধ সারা।একটু পরে টুপি পরা এক লম্বা,চওড়া, স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোক এসে বসলেন আমার পাশের সিটে।ডেলি প্যাসেঞ্জার মনে হল।অনেকেই চেনেন।ঘাড় নাড়ানাড়ি,হাসি ---এসব আর কি।ভদ্রলোককে দেখে আমার মিলিটারিম্যান মনে হয়েছিল।তিনঘন্টা জার্নির মাঝে দুঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট এই ভদ্রলোকের সাথে একটি কথাও হয়নি।অথচ, এই লোকটার সাথেই আগামি কয়েক বছর ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে হবে --কে জানতো? বাস এই মাত্র কর্জনা চটি পেরিয়ে এলো। প্রতি সোমবার এখান থেকেই আরেকজন উঠতো ---মনে পড়তেই মোবাইলে ভেসে এলো "সুরথদা কলিং"---চমকে উঠলাম।

             

বাদশাহি সড়ক দিয়ে বাস এগিয়ে চলেছে। শেষ স্টপেজ মুর্শিদাবাদের কান্দি।ওখান থেকে আরও উত্তরে যাওয়ার বাস যায় NH34 ধরে। উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের যোগাযোগের শর্টেস্ট রুট ।সময়কাল ২০০৬। তখন কিছুটা ঘুরপথে কান্দিগামী বাস বর্ধমান, বীরভূম জেলার প্রান্তিক অঞ্চলগুলি দিয়ে মোরামের রাস্তায় লাল ধুলো উড়িয়ে, ভিড়ে থিকথিক করতে করতে মানুষ,ছাগল,মুরগী, হাঁসসহ প্যাসেঞ্জার নিয়ে বড় বড় গর্তকে ড্রিবল্ করতে করতে এগিয়ে চলতো ধিকিধিকি চালে।বাস এগোচ্ছে... আর পেরিয়ে যাচ্ছে একে একে অপিরিচিত সব নাম--- মঙ্গলকোট,নতুনহাট,বাসাপাড়া,খুজুটিপাড়া...ছোট ছোট গ্রাম,ক্ষয়াটে চেহারা,ন্যাংটো শিশু,আতরের গন্ধ,মাটির দোতলা,একতলা বাড়িঘর,মসজিদ,পুকুর,নয়ানজুলি...অন্ধ বোষ্টমের গলায় কন্ঠি,বোরখার আড়ালে মহিলা...আর চারপাশে শুধু মাঠ আর মাঠ।বেলঘরিয়ার মেস জীবন থেকে কয়েকমাস আগে বাড়ি ফেরা চোখে এসবই নতুন। বাদশাহি সড়কের এই ব্যাকগ্রাউন্ড
যে কলকাঠি নাড়তে শুরু করে দিয়েছে তার প্রান্তিক চেতনার ডালি নিয়ে,বোঝা হয় নি সেদিন।তখনও জানি না এ সড়কের নাম "বাদশাহি " কেন।তখনও সুরথদা বলেন নি,"বুঝলে ভাই,হয়েছে কি,গৌড়ের বাদশাহ তো আক্রমণ করলেন বর্ধমান।ধ্বংস হল বহু হিন্দু মন্দির।আর মানুষ তো মরলোই।এদিকে এক বামুন ব্যাটা এ সব কীর্তি দেখে ঝেড়ে দিলে অভিশাপ---বাদশা তুমি যেই নিজের রাজধানীতে ফিরবে,সঙ্গে সঙ্গে তোমার মৃত্যু হ'বে।এবার তো বাদশা পড়লেন মহা চিন্তায়।রাতের নিদ্,দিনের আরাম ---সবই বিগড়ে গেলো।এই সময় এক পীর বাদশাহকে পরামর্শ দিলেন যে রাজধানী ফেরার পথে এক আজানের আওয়াজ অন্তর(মানে এক মসজিদে আজান দিলে যদ্দুর শোনা যায় আর কি)বাদশাহ মসজিদ তৈরী করতে, পুকুর তৈরী করতে আর যাতায়াতের রাস্তা তৈরী করতে করতে রাজধানীর দিকে এগোতে থাকুন।এই ভাবে যদ্দিনে বাদশাহ রাজধানী পৌঁছাবেন তদ্দিনে তার এন্তেকালের সময় হয়ে যাবে---বাদশার এই আইডিয়া পছন্দ হল...আর তারজন্যই এই রাস্তা...বুঝলে ভাই..."।সুরথদা পাশে বসে আছেন।এখনও পরিচয় হয় নি।কথা হয় নি।রাস্তায় আটমাইল অন্তর মসজিদগুলির অবস্থান জানা হয় নি।পেরিয়ে যাচ্ছে বড় পুকুরের পর পুকুর।বটগাছ,মাটির গাঁথুনি,মাটির ইঁটের ইতিহাস নিয়ে কয়েকটি পরিত্যক্ত মসজিদ আর সবুজ গাছে ভরা কবরস্থান পেরিয়ে বাস থামবে যেখানে, সেই চৌমাথা থেকে ডানদিকে ধরে এগোলে কাটোয়া,বাম দিকে বাস যাচ্ছে বোলপুর,সোজা রাস্তা কান্দি... আর বর্ধমান শহরকে পিছনে ফেলে এসেছি ঘন্টা আড়াই।প্রস্তুতি শুরু নতুন চ্যাপ্টারের।হয়তো প্রস্তুতি নিচ্ছে বাসি লবাণের দেশও তাদের "ঝিলিমিলি মাস্টার"কে প্রথম দেখার অপেক্ষায়---বৃত্তের সাথে বৃত্ত যোগ হওয়ার মুহুর্ত... না কি,আলাদা নতুন বৃত্ত অন্য বৃত্তদের শুধু মাঝে মাঝে ছুঁতে পারা না পারার দোলাচল...আপাতত দশ মিনিট বাস দাঁড়াবে এই স্টপেজে।

                (ক্রমশ)

google.com, pub-4286055196262572, DIRECT, f08c47fec0942fa0

গিলি গিলি গে...

গিলি গিলি গে
*************
সুদীপ ব্যানার্জী

কেউ উলটে দেখলেই খালিটুকু উবে গেল বিস্ময়ে
রেখা এঁকে বেঁকে সাপ ভেবে শিরশিরে
ক্ষমতার বক্রতলে বুলিয়ে দাও কমনীয় হাত
শীত চলে গেলে উষ্ণতা এনে দিও মেলা থেকে
ধুলোবালি এড়িয়ে যতটা হাঁটা যায় একসাথে
সেটুকু জীবন থেকে কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে
বাজি কর মাত্
ওস্তাদ ভ্যানিস জানি না

google.com, pub-4286055196262572, DIRECT, f08c47fec0942fa0

তিনটি লেখা...